এশীয় অঞ্চলে ইন্টারনেটের অগ্রগতি বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে ইন্টারনেটের বিস্তৃতি এ অঞ্চলের তরুণদের জন্য বিশাল সম্ভাবনার সুযোগ নিয়ে এসেছে। তবে, এ সম্ভাবনার সাথে অনলাইনে শিশুদের নিরাপদে রাখার চ্যালেঞ্জ ও অনলাইনের হুমকি থেকে তাদের সুরক্ষিত রাখার গুরুত্বও সামনের দিকে চলে এসেছে। শিক্ষার্থীদের অনলাইনে কার্যক্রম ও আচরণবিধি সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝে উঠতে টেলিনর গ্রুপ আজ নিরাপদ ইন্টারনেটের গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এ গবেষণায়, বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোসহ ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সের ১৮৯৬ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারনেট বিষয়ক জ্ঞান নিয়ে জরিপ চালানো হয়।
টেলিনরের হেড অব সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ওলা জো বলেন, ‘শীর্ষস্থানীয় মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে টেলিনর গ্রুপ ইন্টারনেটে সবার জন্য বিশেষত: তরুণদের মধ্যে নিরাপত্তা বৃদ্ধিতে নিবেদিতভাবে কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, টেলিনর আশা করে, শিশুরা কিভাবে ইন্টারনেট ব্যবহার করবে এ নিয়ে টেলিনরের দেশভিত্তিক এ গবেষণা ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি ইতিবাচক বাবা-মা ও শিক্ষকদের নিরাপদ ইন্টারনেটের গুরুত্ব বোঝার ওপর জোর দিবে। পাশাপাশি, এ গবেষণা ডিজিটাল সম্ভাবনা, বাবা-মায়েদের শিশুদের সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা করা এবং এ নিয়ে তাদের উপদেশ দেয়ার ব্যাপারে উৎসাহিত করবে।’
সাইবার বুলিং সহ ইন্টারনেট সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে স্কুল শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করে টেলিনর এ নিরাপদ ইন্টারনেট গবেষণা পরিচালনা করেছে। প্রভাববিস্তারকারী আচরণের ধরণ বুঝতে, শিশুদের জন্য ইন্টারনেটকে নিরাপদ করে তুলতে এবং এ বিষয়ে কার্যকরী সমাধানের জন্য এ নিরাপদ ইন্টারনেট গবেষণা পরিচালিত হয়েছে।
পারিপার্শ্বিক চাপ
সোশ্যাল নেটওয়ার্কে সহজে প্রবেশের সুযোগ থাকায় শিশুরা পারিপার্শ্বিক চাপের কারণে তাদের জন্য অনুপযোগী ওয়েবসাইট ভিজিট করছে কিংবা অনলাইনে অশালীন ভাষা ব্যবহার করছে। জরিপকৃত শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশ বাংলাদেশি শিক্ষার্থী জানায়, পারিপার্শ্বিক চাপের কারণে তারা একবার হলেও এ ধরনের কাজ করেছে।
সাইবার বুলিং
গবেষণায় আরও জানা যায়, শিশুদের ইন্টারনেটে সহজে প্রবেশাধিকারের কারণে বাবা-মায়েদের কাছে আলোচিত ও শঙ্কার একটি বিষয় হচ্ছে সাইবারবুলিং। গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪৯ শতাংশ স্কুল শিক্ষার্থীর একই ব্যক্তির দ্বারা উৎপীড়নের শিকার হওয়া অথবা অনলাইনে উত্যক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। অথবা, তারা নাম প্রকাশ না করে অনলাইনে অন্যকে উত্যক্ত করেছে।
অনেক শিশুই অনলাইনে শব্দ ব্যবহারের প্রভাব সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারে না। আসলে, ২০১৪ সালে মালয়শিয়ার একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, শিশুদের দুই-তৃতীয়াংশ মনে করে যে, বিব্রতকর এসএমএস পাঠানো, অনলাইনে নিজের পরিচয় গোপন করা ও অনুপযুক্ত ছবি পোস্ট করা সাইবার বুলিং-এর মধ্যে পড়ে না। ২০০৯ সালে টেলিনর নরওয়ে সাইবার বুলিং প্রতিরোধে শিশু, বাবা-মা ও শিক্ষকদের শিক্ষিত করে তুলতে একটি জাতীয় কর্মসূচি পালন করে।
নেতিবাচক অভিজ্ঞতা
শিক্ষার্থীরা প্রায়শই, সাইবারবুলিং ও পারিপার্শ্বিক চাপের শিকার হয়। এরপর তাদের এ নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে সামাল দেয়ার ব্যাপারে তাদের দক্ষতা নিয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বাংলাদেশের ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, তারা মনে করে নিজেরা অথবা বাব-মা ও শিক্ষকদের পরামর্শের মাধ্যমে তারা এ ধরনের সমস্যা সমাধান করতে পারবে।
বাংলাদেশের সাথে তুলনা অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার আরও ৭ শতাংশ বেশি শিক্ষার্থী মনে করে তারা অনলাইনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতাকে সামলে ওঠার জন্য প্রস্তুত। যদিও, পার্থক্যটি খুবই অল্প তারপরেও এটা সম্ভব হয়েছে মালয়েশিয়ায় স্কুল শিক্ষার্থীদের মধ্যে ডিজি সাইবার সেফ কর্মসূচির মতো নিরাপদ ইন্টারনেট নিয়ে ধারাবাহিক উদ্যোগ নেয়ার ফলে।
ঝুঁকি হ্রাস
ইন্টারনেটের মাধ্যমে নতুন কিছু ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এসব ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে ওয়েবসাইটে মাদক, অস্ত্র, আত্মহত্যা এবং নিজেকে ঘৃণা করা জাতীয় প্রচারণা চালানো। তবে, সাধারণ স্কুল শিক্ষার্থীরা এগুলোকে খুব একটা হুমকি মনে করে না। বেশিরভাগ শিক্ষার্থী জানায় তারা এ ধরনের ওয়েবসাইট এড়িয়ে চলে।
এ গবেষণার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৬১ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, তারা অনলাইনে ‘সেক্সটিং’ নামে পরিচিত অশোভন কোনো বার্তা পাঠাবে না।
বাবা-মা ও স্কুল থেকে সাহায্য নেয়া
সারাদেশজুড়ে পরিচালিত এ গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অর্ধেকের কম স্কুল শিক্ষার্থী অনলাইনে এ ধরনের সমস্যায় যখন বুঝতে পারে না কিভাবে এর সমাধান করবে তখন তারা এর সমাধানের জন্য বাবা-মা ও শিক্ষকদের ওপর নির্ভর করে। জরিপকৃত শিক্ষার্থীর মাত্র ৩৮ শতাংশ শিক্ষার্থী জানায়, তারা এ ব্যাপারে বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে। যেখানে থাইল্যান্ডের ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এ ধরনের বিষয় নিয়ে বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করে। নিয়মিতভাবে বাবা-মায়ের সাথে আলোচনা করা ও তাদের পরামর্শ নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অনলাইনে এ ধরনের সমস্যার খুব সহজেই সমাধান করতে পারে ও নিয়মিতভাবে অনলাইনে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারে।
বাবা-মায়েদের এ নিয়ে শিশুদের সাথে খোলাখুলি কথাবলা, আলোচনা করা এবং অনলাইনে এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলে যেনো শিশুরা তাদের বাবা-মায়েদের কাছে সাহায্য চাইতে পারে এ পরিবেশ তৈরি করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিভাবে ইন্টারনেটের অপব্যবহার হতে পারে এ ব্যাপারে শিশুদের সচেতন করার সময় বাবা-মায়েরা একইসাথে ইন্টারনেটের সম্ভাবনা ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করতে পারে। ইন্টারনেটের এমন সব সম্ভাবনার মধ্যে রয়েছে নেটওয়ার্কিং, শিক্ষা ও পরিবেশ।
তান্দ্রে আরও বলেন, ‘যেহেতু, শিক্ষক ও বাবা-মা উভয়ই শিশুকে ইন্টারনেটে নিরাপদে রাখার জন্য তাদের সহয়তা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেক্ষেত্রে পরিবার ও স্কুলের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ এবং সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্ক এ ব্যাপারে সামগ্রিক ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের অনলাইনে ভালো আচরণ করা, বাবা-মা ও স্কুল কর্তৃপক্ষের শিশুদের ইন্টারনেট ব্যবহারে নিয়মিত পর্যবেক্ষণের এবং শিক্ষার্থীদের কিভাবে সাইবার বিশ্বে বিচরণ করা ও বিকশিত উচিৎ এ নিয়ে শিক্ষিত করে তোলার ব্যাপারে উৎসাহিত করে।’
কিভাবে আমরা ইন্টারনেটকে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ করে তুলতে পারি এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে টেলিনর গ্রুপ একটি নিরাপদ ইন্টারনেট গাইডবই প্রকাশ ও বিতরণ করেছে। অবিভাবকরা এ গাইডবইয়ের মাধ্যমে ইন্টারনেট নিয়ে কিভাবে তারা শিশুদের সঙ্গে আলোচনা করবেন এ সম্পর্কে জানতে পারবেন।
এরইমধ্যে গ্রামীণফোন আজ, নিরাপদ ইন্টারনেট সচেতনতা নিয়ে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার এইচইউআরডিসিও ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে একটি সেশন আয়োজন করার মধ্য দিয়ে নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস উদযাপন করেছে।