সোলার প্যানেল বা সৌরশক্তির ব্যবহার নিয়ে তৎপর বাংলাদেশ সরকার সহ দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করে কিভাবে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুতের চাপ কমানো যায় এবং কারা কি ধরনের প্রতিষ্ঠান এ কাজে পারদর্শী, এটির সম্ভাবনা, গ্রাহকসেবা ও প্রতিবন্ধকতাসহ বিভিন্ন বিষয়গুলো নিয়ে টেকসংবাদের সাথে আলোচনা হয় বেইজ টেকনোলজিস -এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ যুবাইর আহমেদ-এর সঙ্গে। তারই স্বর্নক্ষন তুলে ধরা হলো –
টেকসংবাদ – কোন বিষয়গুলো বিবেচনা করে সোলার প্যানেল কেনা উচিৎ এবং সোলার প্যানেল কেনার ক্ষেত্রে গ্রাহক কোন ধরনের প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিবে?
যুবাইর আহমেদ – এটা মূলত নির্ভর করে গ্রাহকের ধরনের ওপর। সরকার থেকে শুরু করে যে কোনো ব্যক্তি সোলার প্যানেলের গ্রাহক হতে পারে। সাধারণ গ্রাহকের ক্ষেত্রে আমি মনে করি প্যণের মান বিবেচনা করার চেয়ে ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে থাকা প্রতিষ্ঠান থেকে সোলার প্যানেল কেনা ভালো। যেমন, ঘরে ব্যবহারের জন্য ইডকল অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকরা পণ্য কিনতে পারেন কারণ এসব প্রতিষ্ঠান ইডকল এবং বুয়েট, এদের অনুমোদন ছাড়া ব্যবসা করতে পারে না। তাই এক্ষেত্রে , প্রতিষ্ঠানগুলোর পণ্যের মান ও গ্রাহকের প্রতি অঙ্গীকার দুটোই কাজ করছে। ইডকল এদের গ্রাহক সেবা ও ওয়্যারেন্টির ব্যাপারেও অনুসন্ধান করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনজিওগুলো গ্রামাঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হোম সিস্টেম হিসেবে সৌর পণ্য বিক্রি করছে। আমি মনে করি, গ্রাহকদের এটাই মূল বিবেচনায় নেয়া উচিৎ কেননা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পণ্যের মান নিশ্চিত করা কঠিন। এখানে নির্ভরযোগ্য উৎস নিশ্চিত করা বেশি জরুরি।
টেকসংবাদ – আমাদের দেশে বিদ্যুতের জাতীয় গ্রিডে সৌরশক্তির ভূমিকা রাখার সম্ভাবনা কতটুকু ?
যুবাইর আহমেদ – দেশের জাতীয় গ্রিডে সৌরশক্তি ব্যবহার হয়ে আসছে। আমরা এখন পর্যন্ত এটার প্রথম ধাপ পার হতে পারিনি, তাই সাধারণভাবে এটা বোঝা যায় না। কিন্তু এর পেছনে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। বাংলাদেশ সরকার কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠানকে এ সুযোগ দিয়েছে। আপনি এখানে বিনিয়োগ করতে পারেন এবং জাতীয় গ্রিডে আপনি বিদ্যুৎ হিসেবে সৌরশক্তি যোগ করে ২০ বছর পর্যন্ত মাসিক বা পাক্ষিক ভিত্তিতে সরকারকে বিল করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আমাদের সম্ভাবনা অনেক। আমরা মাত্র এটা শুরু করেছি। যেহেতু আমাদের গ্যাস ছাড়া জ্বালানির অন্য উৎস নেই সেক্ষেত্রে আমি বলবো সৌরশক্তির মাধ্যমে আমরা এটা করতে পারি। সরকারি ও বেসকারি উভয়ভাবেই এটা নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।
টেকসংবাদ – কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এনার্জি সোর্স হিসেবে সোলার প্যানেল ব্যবহার করতে চায় , আপনারা কতটুকু সহায়তা করে থাকেন?
যুবাইর আহমেদ – সৌর প্যানেল নিতে আগ্রহীরাই আমাদের সম্ভাব্য ক্রেতা। ক্রেতাদের জন্য সর্বোত্তম ও নিরবিচ্ছিন্ন সৌরব্যবস্থা নিশ্চিত করাই আমাদের লক্ষ্য। ক্রেতা চাহিদার ওপর ভিত্তি করে আমরা সেই অনুযায়ী তাদের সেবা দেই। আমাদের দক্ষতা ও লোকবলের কারণে আমরা ক্রেতার ধরণ অনুযায়ী সেবা দিতে পারি। পাশাপাশি, পণ্যের সর্বোচ্চ মান ও ওয়্যারেন্টিও নিশ্চিত করি আমরা।
টেকসংবাদ – সোলার প্যানেলের সব ধরনের যন্ত্রাংশ কি দেশেই উৎপাদিত হয় নাকি আমদানি করা হয়?
যুবাইর আহমেদ – এটার একটা কম্বিনেশন আছে। অনগ্রিড সোলার অর্থাৎ যেখানে শক্তি সঞ্চয়ের কোনো ব্যাপার নেই সরাসরি আপনি বিদ্যুৎ পাচ্ছেন সেখানে ব্যাটারির প্রয়োজন নেই। সেখানে দরকার কন্ট্রোলার পার্ট ও সৌর প্যানেল। সৌর প্যানেল ও কন্ট্রোলারের জন্য আমাদেরকে বিশ্ববাজারের উপর নির্ভর করতে হয়। তাই পর্যাপ্ত দক্ষতা ও জ্ঞানের প্রয়োজন। গ্লোবাল সোর্সিং হলেও আমরা সব প্যানেল নিতে পারি না। আমাদের নিজের দক্ষতা রয়েছে মানসম্পন্ন পণ্য আমদানির। পাশাপাশি, গ্রাহকের সাধ ও সাধ্যের সম্বনয়ের। আমরা নিজেদেরকে সৌর সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আমাদের প্যানেলগুলোর বেশিরভাগই আসে চীন থেকে। ইলেকট্রনিক পার্টসও চীন থেকে আমদানি করা হয়। চীন সবকিছুই উৎপাদন করে। এমনকি জার্মান প্রতিষ্ঠানগুলোও চীনে তাদের পণ্য উৎপাদন করে। আমাদের পণ্যগুলো চীন থেকে আসে কিন্তু আমরা যদি বলে কাদের পণ্য, ডিজাইন কোথাকার তাহলে বলতে হবে এটা জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের। আর যদি আপনি ব্যাটারির কথা বলেন তাহলে আমরা চীনসহ ও স্থানীয় সব ব্যাটারিই ব্যবহার করছি। বর্তমানে আমরা নিজেদের প্রযুক্তিতে পণ্য উৎপাদনের চেষ্টা করছি।
টেকসংবাদ – ব্যবসায় আপনাদের অবস্থান সমন্ধে বলুন ?
যুবাইর আহমেদ – গ্রাহক সমস্যায় অবশ্যই সমাধান প্রতিষ্ঠানকেই দিতে হয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে ঠিক কতোদিন আপনার সোলার পণ্যটি ঠিকভাবে কাজ করবে। আমি বলবো এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক মনোভাব থাকাটা খুব জরুরি। যদি বেইজের ব্যাপারে বলা হয়ে তাহলে বলবো আমারা সোলার প্যানেল দিচ্ছি কিন্তু আমাদের নেটওয়ার্ক অবকাঠামোগত ব্যবসা রয়েছে। আমরা সম্পূর্ণভাবেই সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান। শুরু থেকেই আমাদের লক্ষ্য ছিলো উন্নত গ্রাহক সেবাদান। এখানে প্রতিযোগিতা অনেক বেশি কেননা আমাদের ব্যবসায়িক মডেল পণ্যের ওপর নয় সেবার ওপর নির্ভরশীল। আমি এখনই বলতে পারবো না যে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কি সমস্যায় পড়বে এবং এর সমাধান কি হবে। তবে এতোটুকু বলা যায়, যারা গ্রাহকসেবাদানের মনোভাব নিয়ে এ ব্যবসায় এসেছে তারা সমস্যা শনাক্ত করে এর সমাধান নিয়ে আসতে পারবে। সেদিক বিবেচনায় আমি মনে করি আমাদের প্রতিষ্ঠান বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে।
টেকসংবাদ – সোলার প্যানেল পরিবেশ বান্ধব কিনা ?
যুবাইর আহমেদ – যেভাবে সোলার প্যানেলের ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে একসময় এটা অবশ্যেই চিন্তা করতে হবে। সোলার প্যানেল নবায়নযোগ্য নয়। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে সোলার প্যানেল হাইটেক মনে করা হলেও এটা এক ধরনের স্যান্ডউইচ প্যানলে যার ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশই সিলিকন। সিলিকন থেকে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এ প্যানেল তৈরি করা হয়। সিলিকন ক্ষতিকারক নয়, প্রাণঘাতীও নয়। সিলিকন সরাসরি পরিবেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কিন্তু এতোগুলো প্যানেল যখন অকেজো হয়ে যাচ্ছে তখন দেশের কোথায় এগুলো রাখা হবে। আমাদের রাখার জায়গা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। আবার নতুন করে ওই জায়গাতেও প্যানেল করতে হবে। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে এগোতে হবে আমাদের। সরকারের নীতি নির্ধারণী জায়গা থেকে নেমে এসে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবসা মডেলের মাধ্যমে আমাদের এ ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট করতে হবে। আমাদের এটা নিয়ে ভাবতে হবে কিন্তু এ মুহূর্তে ঠিক এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে ব্যাটারি ক্ষতিকারক এবং এটার জন্য রিসাইক্লিং নীতিমালা থাকা দরকার। যেটা এখনও ঠিকভাবে আমাদেও দেশে নেই।
টেকসংবাদ – এ ব্যবসাখাতের প্রতিবন্ধকতাগুলো কি? বা কোন বিষয়গুলোর কারণে বাজার সম্প্রসারণে প্রতিকূলতা অনুভূত হচ্ছে?
যুবাইর আহমেদ – এখানে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। আপনি যখন নতুন কিছুর উন্নয়ন করতে যাবেন বিশেষত সব ধরনের সোলার প্যানেল নিয়ে শিল্পখাত গড়ে তুলতে গেলে আমাদের স্পষ্ট নীতিমালা থাকা দরকার। এটা সাধারণত দু’ভাবে হয়। এক, সরকার লাইসেন্সের মাধ্যমে নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ ব্যবসার অনুমোদন দিবে এবং দুই, যে সবচেয়ে ভালো সেবা দিতে পারবে সেই এ ব্যবসায় টিকে থাকবে। আমাদের সমস্যা হলো এ দুয়ের কোনটাই হচ্ছে না। যে কারণে আমাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও জনবল থাকলেও আমরা স্বীকৃতি পাচ্ছি না। এটার একমাত্র সমাধান হচ্ছে সুষ্ঠু নীতিমালা।
টেকসংবাদ – সোলার প্যানেলকে ব্যক্তি উদ্যোগে ব্যবসায়িক মডেলে পরিণত করা যায় কিনা?
যুবাইর আহমেদ – অন্যান্য দেশের সরকার সৌরশক্তির ক্ষেত্রে নেট মিটারিং নিয়ে এসেছে। এটা হচ্ছে, আপনি যখন সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আপনার নিজের ব্যবহারের পর বাকিটা সরকারকে গ্রিডে দিবেন তখন সরকার এর দ্বিগুণ বা তিনগুণ বিদ্যুৎ আপনাকে বিনামূল্যে দিবে। যেমন, আপনি সরকারকে এক ইউনিট বিদ্যুৎ দিলে সরকার আপনাকে তিন ইউনিট বিদ্যুৎ দিবে। তিন ইউনিট বিদ্যুৎ পাওয়া মানে এর সমপরিমাণ অর্থ পাওয়া। এটা আপনি পরে প্রয়োজনে বিদ্যুৎ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছেন। এর মাধ্যমে তিন থেকে চার বছরের মাধ্যমে আপনার সৌর প্যানলের বিনিয়োগটা উঠে আসবে। কিন্তু প্যানেলতো চলবে আরও ১৫ থেকে ২০ বছর। তাই এটা যেকোনো বাড়ির মালিকের জন্য এক ধরনের ব্যবসায়িক মডেল। পশ্চিমের প্রায় সবদেশেই এটা রয়েছে। আমাদের কাছাকাছি মালয়েশিয়াতে খুব কার্যকরী উপায়ে এটা চলছে। সিঙ্গাপুর এবং চীনেও রয়েছে। একটা ট্রান্সফার সুইচের মাধ্যমে নিজের বাসার প্যানেলের সাথে সরকারি গ্রিডে বিদ্যুৎ লেনদেন সম্ভব। এখন দরকার সরকারি উদ্যোগ।
টেকসংবাদ – ধন্যবাদ
যুবাইর আহমেদ – ধন্যবাদ টেকসংবাদকে।