জমজমাট আয়োজনে শেষ হল এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড। গত ৬ ডিসেম্বর ‘রেডি ফর টুমরো’ স্লোগানে দেশের তথ্যপ্রযুক্তির বড় এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আজ শনিবার সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে চার দিনব্যাপী তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় উৎসবের সফল পরিসমাপ্তি ঘটলো।
বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের হল অব ফেমে আজকের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং তরুণদের প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ। আগামী বাজেটে ইন্টারনেটের উপর থেকে ভ্যাট কমানোর বিষয়টি অর্থমন্ত্রী বিবেচনায় রাখবেন বলে অনুষ্ঠানে জানান।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ বলেন, ঢাকা শহরে অসংখ্য গাড়ি। এজন্য জ্যাম হয়। এটাকে বলে ডেভেলপমেন্ট পেইন। তবে বিদেশিরা যখন আসেন তখন এর মধ্যেই সম্ভাবনা খুঁজেন। বিদ্যমান অবস্থা থেকে উন্নয়নের নতুন ধারায় প্রবেশের ফল এটা। এসব পরিবর্তনই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ইঙ্গিত দেয় । যা আমাদের দেশকে বদলে দেবে। বাড়বে দেশের অর্থনীতির পরিধি।
জুনাইদ আহমেদ পলক আরও বলেন, আমরা এবার সোফিয়াকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম। তার কথা শুনেছি। তাই বলে কি আমরা নিজেরা সোফিয়ার মতো এমন রোবট তৈরি করবো না? ইতোমধ্যে আমি ইনোভেশন জোনে বন্ধু নামের এক রোবটের সঙ্গে কথা বলেছি।তার বয়স মাত্র দুই সপ্তাহ। তাই ভালো করে কথা শেখেনি। তবে প্রধানমন্ত্রী যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, সামনের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে নিজেদের তৈরি সোশ্যাল রোবট থাকবে। ইনশাল্লাহ আমরা সেটা পারবো।
ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান আহমেদ এমপি বলেন, তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন পণ্যের উপর থেকে শুল্ক তুলে নেয়ার জন্য অথমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তিনি। এছাড়া আগামী বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উপর বিশেষ বরাদ্দ রাখার জন্য অথর্মন্ত্রীকে অনুরোধ জানান তিনি।
আইসিটি বিভাগের সচিব সুবীর কিশোর চৌধুরী বলেন, এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড জমকালো আয়োজনে শেষ হয়েছে । এতে ৫ লাখেরও বেশি দর্শনার্থী আমাদের আয়োজন স্বশরীরে উপভোগ করেছেন। অনলাইনে ১৯ লাখেরও বেশি মানুষ সম্পৃক্ত থেকেছেন।
বেসিস সভাপতি মোস্তাফা জব্বার বলেন, এই মেলায় প্রথমবারের মতো মেড ইন বাংলাদেশ প্রোডাক্ট দেখাতে সক্ষম হয়েছি আমরা। এটি আমাদের বিশাল অর্জন। বাংলাদেশ এখন ৪র্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্বে দেয়ার মতো দেশ। আমাদের তরুণরা এখন ভুটান নেপালের সরকারের জন্য সফটওয়্যার রপ্তানি করে। জাপানেও আমাদের সফটওয়্যার রপ্তানি করা হয়।
শেষ দিনের যত আয়োজন
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের চতুর্থ দিন আজ আটটি সেমিনার ও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এগুলো হলো-আইসিটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প, দ্য প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জ অব ডিজিটাল বাংলাদেশ কারেন্সি ইন বাংলাদেশ, ডিজিটাল মার্কেটিং ফর ফিউচার, টুমরোস স্কিলস টু গেট রেডি ফর ফোর্থ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভ্যালিউশন, অ্যাপিকটা, অগমেন্ট রিয়ালিটি অ্যান্ড ভার্চুয়াল রিয়ালিটি, ডিজিটাল অপরচুনিটি অব গ্রোথ এবং ইনোভেশন ইন গর্ভনমেন্ট।
ডিজিটাল মার্কেটিং ফর ফিউচার
অ্যাফিলিয়েট মার্কেটিং এর মাধ্যমে ই-কর্মাস সাইটে পণ্যের প্রচার করে যে কেউ ঘরে বসেই আয় করতে পারে। অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশেও এই ট্রেন্ড দিনে দিনে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইটগুলো তাদের পণ্যের প্রচার করার সুযোগ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বাড়তি আয়ের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। ভবিষ্যতে অনলাইনে আয়ের অন্যতম খাত হবে এই ডিজিটাল মার্কেটিং। এ খাতে দেশের তরুণদের আগ্রহ বাড়ছে। ‘ডিজিটাল মার্কেটিং ফর ফিউচার’ শীর্ষক এক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।
‘দ্য প্রসপেক্ট অ্যান্ড চ্যালেঞ্জেজেস অব ডিজিটাল কারেন্সি ইন বাংলাদেশ’
২০১১ সালে বাংলাদেশে মোবাইলে অর্থ লেনদেন সেবা চালু হয়। বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং সেবা সারা বিশ্বের প্রেক্ষাপটে একটা অনন্য দৃষ্টান্ত। এই সেমিনারে কি-নোট স্পিকার হিসেবে বক্তব্য রাখেন শিউর ক্যাশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সাহাদাত খান।
আগামী দিনের দক্ষতা ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লব
প্রযুক্তির নানা উদ্ভাবনের ফলে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের সার্বিক কার্যক্রম ডিজিটালাইজড হচ্ছে। এর ফলে চতুর্থ শিল্প আসন্ন। এই বিপ্লব মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ভীত নয় বরং বাংলাদেশ প্রস্তুত রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমান।
আইটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প
ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের চতুর্থ দিন দুপুরে হল অব ফেমে অনুষ্ঠিত হয় আইটি ক্যারিয়ার ক্যাম্প। এই খাতে বিশেষজ্ঞরা আইসিটি খাতে ক্যারিয়ার গড়তে নানা ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। ক্যারিয়ার ক্যাম্পে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক উপস্থিত ছিলেন। এতে কয়েক হাজার শিক্ষার্থী ও চাকুরিপ্রার্থী অংশ নেয়।
অ্যাপিকটা ইয়ুথ কার্নিভাল
আইসিটি অস্কারখ্যাত অ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ড এবার বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আগামীকাল রবিবার অ্যাপিকটা আওয়ার্ডের চূড়ান্ত আসর বসবে। ইতোমধ্যে বিচারকদের সামনে প্রতিযোগীরা তাদের উদ্ভাবিত প্রকল্পগুলো উপস্থাপন করেছেন। অ্যাপিকটা অ্যাওয়ার্ডে অংশ নেয়া বিদেশি প্রতিনিধিও বিচারকদের সঙ্গে ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার জন্য ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের শেষ দিন একটি গেট টু গেদারের আয়োজন করা হয়।এতে অ্যাপিকটার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বেসিসসহ অ্যাপিকটার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
অগমেন্টেড রিয়ালিটি এবং ভার্চুয়াল রিয়ালিটি
অগমেন্টেডেড রিয়ালিটি অ্যান্ড ভার্চুয়াল রিয়ালিটি নিয়ে শেষ দিন বিকালে একটি সেমিনারের আয়োজন করা হয়। এতে সারাবিশ্বে অগমেন্টেড রিয়ালিটি অ্যান্ড ভার্চুয়াল রিয়ালিটির উত্থান তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে এই প্রযুক্তির সঙ্গে বাংলাদেশ কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে সে সম্পর্কেও আলোচনা করা হয়।
ডিজিটাল অপরচুনিটি ফর ইয়ুথ
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের মধ্যে তরুণদের সংখ্যাই বেশি। এই তরুণদের আইসিটি খাতে সম্পৃক্ততা বাড়িয়ে ২০২১ সালের মধ্যে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আইসিটি এক্সপোর্ট করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। তাই প্রশিক্ষিত জনশক্তি গড়ে তুলতে হলে তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। ডিজিটাল অপরচুনিটি ফর ইয়ুথ সেমিনারে বক্তারা আইসিটি খাতে তরুণদের সম্পৃক্ততা বাড়াতে সরকারের নানামূখী পদক্ষেপের কথা জানানো হয়।
ইনোভেশন ইন গভর্নমেন্ট
ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে সরকার নানামুখী উদ্ভাবনী ধারণা গ্রহণ করেছে। সরকারের উদ্ভাবনগুলো সবার মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কথা জানাতে ‘ইনোভেশন ইন গভর্নমেন্ট’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছিল ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের চতুর্থ দিন বিকালে। এতে সরকারি প্রতিনিধি ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা সরকারের উদ্ভাবনী প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করেন।
এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড বৃহৎ পরিসরে আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়। চার দিনব্যাপী এই আয়োজনে গুগল-নুয়ান্স, অ্যাংরিবার্ডসহ খ্যাতিমান তথ্যপ্রযুক্তি সংশ্লিষ্ঠ প্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই শতাধিক বক্তা মোট ৪৭ এর অধিক সেমিনারে অংশ নেয়।
স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে আইটি ক্যারিয়ার-বিষয়ক সম্মেলনের পাশাপাশি উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে ছিল ডেভেলপার সম্মেলন।
এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে ৩৪৭টি প্রতিষ্ঠান ৫০১টি স্টল ও প্যাভিলিয়ন সাজিয়েছিল। প্রযুক্তি প্রেমীদের জন্য প্রদর্শনীতে সফটওয়্যার শোকেসিং, ই-গভর্নেন্স এক্সপো, স্টার্টআপ জোন, কিডসজোন, মেড ইন বাংলাদেশ জোন এবং ইন্টারন্যাশনাল জোন ছিল। এছাড়াও আইসিটি সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু প্রদর্শনী স্টল তাদের প্রযুক্তিপণ্য ও সেবা সম্পর্কে ধারণা উপস্থাপন করে।
এবারের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডের মূল আয়োজক সরকারের আইসিটি ডিভিশন। সহযোগী ছিল বেসিস, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, এটুআই। অংশীদার হিসেবে ছিল বিসিএস, বাক্য, আইএসপিএবি, বাংলাদেশ উইমেন ইন আইটি (বিআইডব্লিউটি), ই-ক্যাব, বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম, সিটিও ফোরাম,.বিডিওএসএন, মায়া আপা, বিআইজেএফ, বোল্ড এবং ভিসিপিইএবি। এই আয়োজনের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ছিল ইসলামিব্যাংক, হুয়াওয়ে, ইসলামি ব্যাংক, রকেট, ওরাকল এবং আমরা।
প্রদর্শনী চলে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত। এতে প্রবেশের জন্য আগতরা অনলাইনে নিবন্ধন করেন। স্পট নিবন্ধনের সুযোগও ছিল। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড আয়োজনের বিস্তারিত তথ্য মিলবে এই ওয়েবসাইটে: www.digitalworld.org.bd