“উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনী পরিবেশ তৈরিতে নারীর ভূমিকা” প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে আজ ১৯ নভেম্বর ২০১৯ মঙ্গলবার রাজধানীর আগারগাঁও আইসিটি টাওয়ারে অনুষ্ঠিত হল “নারী উদ্যোক্তা দিবস- ২০১৯” উপলক্ষে একটি বিশেষ সেমিনার। সেমিনারটি আয়োজন করে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল এর অধীনে “উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প (iDEA)।
প্রতিবছর ১৯ নভেম্বর পালিত হয় “নারী উদ্যোক্তা দিবস”। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে আত্নপ্রকাশ ও তাদের উদ্ভাবনী মেধা শক্তিকে কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে সমাজের উন্নয়নে এগিয়ে আসার আহ্বানে এবং অনুপ্রেরণাদানের লক্ষ্যে এই দিবস সারা বিশ্বে উদযাপন করা হয়। এই দিবসে বিভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে নারীদের তাদের সৃজনশীল চিন্তা ও উদ্ভাবনী মেধা বিকাশের পথকে পরিচয় করায় এবং একই সাথে ভবিষ্যতে কর্মের মাধ্যমে তারা সারা বিশ্বের বুকে যাতে অবদান রাখতে পারে সেই সাহস যোগায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও সমাজের ও জাতির উন্নয়নের পথযাত্রী। এই দিবস কর্মক্ষেত্রে তথা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণে নারী-পুরুষ এর দূরত্ব কমিয়ে আনার পাশাপাশি সমাজে সমতা ফিরিয়ে আনা ও নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে। এই বিষয়গুলোকে সামনে রেখে “উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প (iDEA) তার স্টার্টআপ বাংলাদেশ ব্যানারে আয়োজন করে এই সেমিনার।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি । বিশেষ অতিথি হিসেবে ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মাননীয় উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, এমপি , বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর নির্বাহী পরিচালক পার্থপ্রতিম দেব, বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সভাপতি ড. রুবানা হক এবং ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সভাপতি শমী কায়সার। অনুষ্ঠানটিতে সভাপতিত্ব করেন “উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প” (iDEA) এর পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) সৈয়দ মজিবুল হক।
সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক, এমপি বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রতিটিক্ষেত্রে নারীদের প্রাধান্য দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। দেশে বিচারপতি হতে শুরু করে সকল পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি রয়েছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য ২০১৮’ প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সবার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ তার সার্বিক লিঙ্গবৈষম্য ৭২ শতাংশ কমিয়ে আনতে পেরেছে। বাংলাদেশে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের এনরোলমেন্টের সংখ্যা বেশি। প্রায় ১
কোটি ৩০ লক্ষ মায়েদের কাছে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষাবৃত্তির টাকা “মায়ের হাসিঁ” প্রকল্পের মাধ্যমে পৌছে দেওয়া হচ্ছে; বছরের প্রথম দিন ৩৮ কোটি বই সাড়ে ৪ কোটি ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে বিনামূল্যে পৌছে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে বই কেনার পয়সা লাগছে না, নারী শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার জন্যে বেতন দিতে হচ্ছে না, এমনকি স্কুলে টিফিনের ব্যবস্থাও করে দিয়েছে জননেত্রী শেখ হাসিনা। ফলে এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সব সময় একটি কথা বলেন আর সেটা হল নারীর ক্ষমতায়নের মূলভিত্তি হল নারীর আর্থিক স্বাধীনতা। অর্থাৎ যদি একজন মেয়ে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হয় তখনই কেবল সম্ভব তার ক্ষমতায়নটাকে নিশ্চিত করা। এছাড়া তিনি আরো বলেন যে সরকার নারীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ভাতা প্রচলন করেছে।
পোশাক শিল্পে পৃথিবীর ২য় সর্বোচ্চ রপ্তানীকারক দেশ হল বাংলাদেশ। রপ্তানী আয়ের ৩৪ বিলিয়ন ডলারের প্রায় ৮০ শতাংশ কন্ট্রিবিউট করছে নারী। আমাদের পুরো অর্থনৈতিক কাঠামোর মূল ভিত্তি দাড়িয়ে আছে নারী উদ্যোক্তা ও নারী সমাজের উপর। অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান বলছে সবচেয়ে বেশি অবদান আমাদের নারী সমাজের। প্রতিমন্ত্রী সবশেষে দেশে একটি স্টার্টআপ কালচার তৈরির জন্য নারীপুরুষ সকলকে সমানভাবে কাজ করার আহ্বান জানান ও একই সাথে তরুণ নারী উদ্যোক্তাদের তিনি স্টার্টআপ বাংলাদেশ- iDEA প্রকল্পে তাদের উদ্ভাবনী আইডিয়া দাখিলের জন্য অনুপ্রাণিত করেন এবং এই ক্ষেত্রে স্টার্টআপ বাংলাদেশ থেকে প্রয়োজনীয় সকল সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপ-মন্ত্রী হাবিবুন নাহার, এমপি বলেন, সত্যিকারের অর্থে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য। তিনি সর্ব সেক্টরকে নারী বন্ধব করার চেষ্টায় আছেন। কারণ নারী জাগরণ শুধু মুখে নয়, কর্মক্ষেত্রেও প্রমাণ করতে হবে। সমাজের বিশেষ অংশ হল নারী। তাই নারীদের সামনে এগিয়ে যাবার জন্য তিনি সকল নারীদের আহ্বান জানান।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি) এর নির্বাহী পরিচালক পার্থপ্রতিম দেব বলেন যে, বাংলাদেশে নারী বান্ধব পরিবেশ ও পলিসি তৈরিতে সরকার কাজ করছে। বর্তমানে যে সকল প্রকল্পগুলো চলছে এগুলো শুরু হবার আগের থেকেই বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিভিন্ন ধরণের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। এ পর্যন্ত প্রায় ১ লক্ষ বা এর বেশি নারী ও পুরুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে যার ত্রিশ শতাংশই নারী। তিনি সকলকে আগ্রহ নিয়ে সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হোসনে আরা বেগম বলেন যে, আমরা নারীরা সকলের সাথে মিলে কাজ করি ও করতে চাই। মেয়েরা এখন ঘরে বসেও কাজ করছে। সংসারে স্বচ্ছলতা এনে দিচ্ছে। নারীদের মাথায় রাখতে হবে যে নারীরা সমাজের একটা বড় অংশ। সেই লক্ষ্যে নারীদের সাহসের সাথে সামনে এগিয়ে যেতে তিনি উৎসাহিত করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) এর সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, সব নারীরই একই কথা। নারীদের সমস্ত কষ্টের জায়গা এক। নারীরা কোন অজুহাত দিতে পারে না। তাই নিজের স্থান নিজেকেই করতে হবে। নারী কখনও হেরে যায় না। তিনি নারীদের কোন অবস্থায় হাল না ছাড়তে অনুরোধ করেন। একজন নারীকেই আরেক নারীর পাশে দাড়াতে হবে। এছাড়া তিনি নারীদের এ্যাকসেস টু ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে সহজীকরণের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ক্রেডিট পোর্টালের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন এবং দ্রুত চালুকরণেরও জোর প্রস্তাব করেন।
বিশেষ অতিথি হিসেবে ই-কমার্স এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর সভাপতি শমী কায়সার বলেন যে, নারীদের নিজেদের জায়গাটা শুরু হয় নিজেদেরে বাড়ি থেকে। মেয়েরাই মেয়েদের শক্তি। মেয়েরা যখন আরো কয়েকজনকে নিয়ে একসাথে হয় তখনই তৈরি হতে পারে একটি পাওয়ারফুল কমিউনিটি। দেশে প্রফেশনাল নারী নেতৃত্ব তৈরি হয়েছে। এছাড়া তিনি আরো বলেন উদ্যোক্তা সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনী পরিবেশ এখন থেকে ২০ বা ২৫ বছর পূর্বে ছিলনা। আমাদের দেশের নারীরা এসএমই সেক্টরে ভালো করছে। দেশে প্রাইভেট বা কর্পোরেটে নারীরা অনেক দক্ষতার সাথে কাজ করছে। কিন্তু নারীদেরকে আমরা বড় বড় বিজনেস ক্ষেত্রে ও ইন্ডাস্ট্রিতে বড় জায়গায় দেখতে চাই।
অনুষ্ঠানের সভাপতি “উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন একাডেমী প্রতিষ্ঠাকরণ প্রকল্প” (iDEA) এর পরিচালক (অতিরিক্ত-সচিব) সৈয়দ মজিবুল হক তার স্বাগত বক্তব্যের শুরুতে আমন্ত্রিত অতিথিদেরসহ সকল নারীদের নারী উদ্যোক্তা দিবসের শুভেচ্ছা জানান এবং আইডিয়া প্রকল্পের কার্যক্রম নিয়ে ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন যে নারী উদ্যোক্তাদের সহোযোগিতার লক্ষ্যে ওয়ান স্টপ সার্ভিস পরিচলনার পরিকল্পনা করছে iDEA প্রকল্প। তিনি iDEA প্রকল্পে নারীদের তাদের উদ্ভাবনী আইডিয়াগুলো কিভাবে আবেদন করবে সেই সম্পর্কে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন যে উদ্যোগ গ্রহণে ফান্ডিং, কো-ওয়ার্কিংস্পেস প্রদান, ট্রেড লাইসেন্সসহ যেকোন প্রকার সহোযোগিতায় নারীদের বিশেষ সহোযোগিতায় পাশে থাকবে iDEA প্রকল্প।
নারীদের জন্য সেমিনারটি উন্মুক্ত সেমিনারটিতে বেসিস, ই-ক্যাব, ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম-উই, উইমেন অন্ট্রপ্রিনিয়রস অফ বাংলাদেশ-উইবিডি, কল্যানী, নিবেদিতা এবং অন্যান্য বিভিন্ন সংগঠন থেকে শতাধিক নারী উদ্যোক্তারা অংশ নেয়। সংগঠনগুলো থেকে বক্তব্য রাখেন শারমিন আকতার সাজ (উইমেন অন্ট্রপ্রিনিয়রস অফ বাংলাদেশ-উইবিডি), আনিকা ইসলাম (নিবেদিতা), ফারজানা তণ্বি (ওমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম-উই), রাবেয়া খাতুন (iSocial এর কল্যানী)। এছাড়াও সেমিনারে অতিথিগন উপস্থিত নারী উদ্যোক্তাদের সাথে তাদের বিভিন্ন বাস্তব অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন এবং নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নারীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। সেমিনারটির ২য় অংশের পরিচালনা করেন আইডিয়া (iDEA) প্রকল্পের উপ-প্রকল্প পরিচালক (উপসচিব) কাজী হোসনে আরা এবং উপস্থাপনায় ছিলেন প্রকল্পের আইন বিষয়ক পরামর্শক আদনীন জেরিন।