ডিজিটাল বুলিং-এর ধরন, তরুণ প্রজন্মের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব এবং তরুণরা কিভাবে ডিজিটাল বুলিং মোকাবিলা করছে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দিতে ‘নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস ২০১৭-তে’ সাইবার বুলিং নিয়ে পরিচালিত একটি জরিপের ফলাফল প্রকাশ করেছে টেলিনর গ্রুপ। প্রধানতঃ বাংলাদেশ, ভারত, মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, পাকিস্তান, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও এশিয়ার অন্যান্য দেশের ৩শ’ ২০ জন প্রাপ্তবয়স্ক অংশগ্রহণকারীকে নিয়ে জরিপটি ফেসবুকে পরিচালিত হয়। যদিও সবগুলো দেশেই সাইবার বুলিং ঘটছে, জরিপে অংশগ্রহণকারীরা জানিয়েছেন, তারা তরুণদের সাথে সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা করেন এবং তারা মনে করেন ক্রমেই এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। আর এটা তাদের ডিজিটাল মাধ্যমে অশালীন আচরণ প্রতিহত করতে এবং ভুক্তভোগীদের অনুভূতির সাথে একাত্মতা পোষণে সহায়তা করবে। ১৮ থেকে ৬৪ বছর বয়সী ফেসবুক ব্যবহারকারী যাদের অবিভাবকত্ব, পারিবারিক সমস্যা, শিশুকল্যাণ ও অনলাইনে নিরাপত্তা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে তাদের লক্ষ্য করে জরিপটি পরিচালিত হয়।
এ নিয়ে টেলিনর গ্রুপের সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি ডিরেক্টর জয়নাব হুসাইন সিদ্দিকী বলেন, ‘ডিজিটাল বুলিং এর বর্তমান অবস্থা ও এর বিস্তার, ডিজিটাল বুলিং এশিয়ার শিশুদের ওপর কিরকম নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক উভয়েই এ ব্যাপারে কি করতে পারে তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা পেতে নিরাপদ ইন্টারনেট দিবস উপলক্ষ্যে আমরা এ ডিজিটাল জরিপ পরিচালনা করেছি।’ তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে, উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় হচ্ছে, এশিয়াজুড়েই আমরা সাইবার বুলিং এর বিরুদ্ধে সচেতনা বৃদ্ধির অনেক প্রয়াস লক্ষ্য করেছি। আমাদের প্রতিষ্ঠানসহ অনেকেই এ নিয়ে শিশু, বাবা-মা ও বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আমরা আশা করছি, এটা অনলাইনে র্দুব্যবহারের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।’
সর্বপ্রথম করণীয়: বাব-মায়েরা জানিয়েছেন, তারা তাদের সন্তানদের সাথে সাইবার বুলিং নিয়ে আলোচনা করেন । কিভাবে এবং কোন চ্যানেলের মাধ্যমে অনলাইনে অশোভন কার্যক্রম ঘটতে পারে, কিভাবে এটা সংঘটিত হয় এবং কিভাবে এর বিরুদ্ধে রিপোর্ট করতে হয়, এসব শিশুদের বোঝানোর প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে আলোচনা করা। এ জরিপের প্রাপ্ত ফলাফলের অন্যতম বিষয় হচ্ছে, জরিপের ফলাফল ইতিবাচক অবস্থা নির্দেশ করছে। জরিপে উত্তরদাতাদের বেশিরভাগ (৪৬ শতাংশ) জানিয়েছেন, তারা ইন্টারনেট ও অনলাইনে আচরণ নিয়ে সবসময়েই তাদের সন্তানদের সাথে কথা বলেন। ৩৯ শতাংশ জানিয়েছেন, তারা মাঝে মাঝে তাদের সন্তানদের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেন। মাত্র ১২ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, তারা কখনই তাদের সন্তানদের সাথে এ ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। এশিয়ার প্রাপ্তবয়স্কদের একটা বড় অংশ মনে করেন, তারা অনলাইনে তরুণদের নিরাপত্তা নিয়ে অবগত এবং যথেষ্ট সচেতন।
সাইবার বুলিং-এর সাধারণ অভিজ্ঞতা জরিপে অংশগ্রহণকারীদের (২২.৫ শতাংশ) সন্তানদের সাইবার বুলিং-এর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে বেশিরভাগই শত্রুভাবাপন্ন, বিরূপ মন্তব্য এবং অনলাইনে অবমাননাকর উক্তি জাতীয় সাইবার বুলিং-এর শিকার হয়েছে। উত্তরদাতাদের আরেকটা বড় অংশ জানিয়েছেন, তারা জানেন না তাদের সন্তানদের তালিকাভুক্ত কোনো সাইবার বুলিং-এ শিকার হওয়ার ঘটনার কথা। এরপরে উত্তরদাতাদের আরেকটি বড় অংশ জানিয়েছেন, সাইবার বুলিং নিয়ে তাদের সন্তানদের প্রশিক্ষণ দেয়ার ফলে এবং এ অবস্থার শিকার হলে তারা (সন্তানরা) কি করবে এটা জানার কারণে শিশুরা সাইবার বুলিং এর শিকার হয়নি।
সাইবার বুলিং- এ আক্রান্ত হওয়ার নানা প্রভাব সাইবার বুলিং-এর অভিজ্ঞতা সন্তানদের ওপর কি রকম প্রভাব ফেলছে এমন প্রশ্নের জবাবে উত্তরদাতা অবিভাবকরা বিভিন্নরকম উত্তর দিয়েছেন, অনেকক্ষেত্রে আশ্চর্যজনক নানা উত্তরও এসেছে। তারা জানিয়েছেন, শিশুরা কিভাবে অনলাইন বুলিং-এর মোকাবিলা করবে এবং কি করে এটাতে আক্রান্ত না হয়ে অগ্রাহ্য করবে এ বিষয়ে জানা শিশুদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। ২৯ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, সাইবার বুলিং শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তারা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হতাশায় ভোগে। ২৪ শতাংশ জানিয়েছেন, এ অবস্থা শিশুদের আরও অনেক সাবধানী করে তোলে এবং তারা নিজেদের অনলাইনে আত্মরক্ষা করতে শেখে। আরও ২৪ শতাংশ মনে করেন, তাদের মনে হয় না তাদের সন্তানরা সাইবার বুলিং-এ আক্রান্ত। ৭ শতাংশ জানিয়েছেন, অনলাইন বুলিং-এ আক্রান্ত শিশুরা এ ব্যাপারে অন্য শিশুদের সহায়তা করতে উৎসাহিত বোধ করে।
সাইবার বুলিং ও অনলাইন গেমিং যাদের সন্তানরা অনলাইনে গেম খেলে তাদের সাইবার বুলিং এ আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা অনলাইনে যারা সাধারণ ব্রাউজিং করে তাদের চেয়ে বেশি। জরিপে ৭৯ শতাংশ জানিয়েছেন, তাদের সন্তান এবং পরিচিত শিশুরা বিশেষ করে ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনলাইন গেমস খেলার সময় শারীরিকভাবে আক্রান্ত হওয়ার হুমকির শিকার হয়েছে। এটা ঘটে বিশেষ ওয়েবসাইটে অথবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্মে। ৪১ শতাংশ জানিয়েছেন, শিশুরা অনলাইনে যেসব আপত্তিকর মন্তব্যের শিকার হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে গালাগালি, বর্ণবাদী ও যৌনতা বিষয়ক মন্তব্য।
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়: উপযুক্ত ওয়েবসাইট নিয়ে শিক্ষাদান
জরিপে ২৭ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন, শিশুদের অনলাইনে নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিলো তাদের জন্য কোন ওয়েবসাইট বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিরাপদ আর কোনগুলো থেকে তাদের দূরে থাকা উচিৎ এ সম্পর্কে শিশুদের অবগত করা। এরপরেই ছিলো ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা (২৬ শতাংশ) এবং অনলাইনে অনেকেই নিজের পরিচয় লুকিয়ে বেনামে বিভিন্ন বিষয় পোস্ট ও শেয়ার করে এ সম্পর্কে জানা (২৫ শতাংশ)।
অন্যান্য ঝুঁকি: ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করা এবং অনুপযুক্ত ওয়েবসাইটে যাওয়া
তরুণদের ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ে প্রাপ্তবয়স্কের যে উদ্বেগ, সাইবার বুলিং- তারই একটি অংশ। এক্ষেত্রে, জরিপের ফলাফল নির্দেশ করে, শিক্ষার মাধ্যমেই ঝুঁকিপূর্ণ অনলাইন আচরণ প্রতিরোধ করতে হবে। ৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানিয়েছেন তাদের সন্তানরা অনলাইনে অপরিচিত ব্যক্তির কাছে ব্যক্তিগত তথ্য দিয়েছে। ৫১ শতাংশ জানিয়েছেন তাদের সন্তানরা অনুপযুক্ত ওয়েবসাইটে গিয়েছে। অনলাইন স্ক্যাম এবং ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম বেড়ে যাওয়া সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে উত্তরদাতারা জানিয়েছেন, তাদের সন্তান এবং পরিচিত শিশুরা ই-মেইল ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হ্যাকিং এবং এনএসএফডব্লিউ (নট সেফ ফর ওয়ার্ক) ছবি বা ভিডিও শেয়ারিং মতো ঘটনার এর শিকার হয়েছে।
ডিজিটাল বুলিং- এর ক্ষেত্রে করণীয় এবং কিভাবে অনলাইনে নিরাপদে থাকা যায় ও মোবাইল ডিভাইস সুরক্ষিত রাখা যায় এসব নিয়ে শিশু ও বাবা-মায়েদের তথ্য দিয়ে সচেতন করেছে ‘বি স্মার্ট ইউজ হার্ট’ শীর্ষক বৈশ্বিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে টেলিনর। শিশুদের সাথে ইন্টারনেট নিয়ে বাবা-মায়েরা কিভাবে কথা বলবে এ নিয়ে টেলিনর গ্রুপ একটি গাইড বইও প্রকাশ করেছে। https://www.telenor.com/wp-content/uploads/2015/11/SAFE-BOOK-INTL-TG_safe_internet_book_NOv_2015_Group_webres.pdf গাইডবইটি বাংলা, বার্মিজ, থাই, বাহাসা, চীনা ও উর্দু ভাষাতেও প্রকাশ করা হয়েছে।