যথাযথ নজরদারি ও পরিকল্পনার অভাবে হুমকির মুখে পড়তে যাচ্ছে দেশব্যাপী ব্রডব্যান্ড সম্প্রসারণ কার্যক্রম। নিয়ম বহির্ভূতভাবে গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার কার্যাদেশ আইএসপির (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) পরিবর্তে এনটিটিএনকে (ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক) দেয়ার প্রস্তাবেই মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়তে যাচ্ছে এ খাত। এ প্রস্তাব অনুমোদিত হলে একদিকে যেমন দেশব্যাপী ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হবে, অন্যদিকে লঙ্ঘণ করা হবে সরকারের তৈরি করা নীতিমালা। পাশাপাশি শুধু দুটি এনটিএন লাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান লাভবান হলেও ব্যবসা গুটিয়ে ফেলতে হবে লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র আইএসপি ব্যবসা। আজ ঢাকার স্থানীয় এক হোটেলে এসব কথাই জানান দিচ্ছিলেন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের সংগঠন-আইএসপিএবি। সংগঠনের সভাপতি আমিনুল হাকিমের সভাপতিত্বে এতে কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। মুলত প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনার জন্যই এই সংবাদ সম্মেলন।
ইনফো-সরকার (৩য় পর্যায়) প্রকল্পের আওতায় দেশের ২৬০০ ইউনিয়নে ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের এ ভালো উদ্যোগটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে যাচ্ছে বিসিসি (বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল), বেসরকারী এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো। একনেকের সিদ্ধান্তকে অমান্য করে ৮টি পর্যায়ের দরপত্রকে দুটি ভাগে দিয়ে দিয়েছে বিসিসি। আর যোগাসাজশের মাধ্যমে সামিট কমিউনিকেশন ও ফাইবার অ্যাট হোম নামে দুটি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান এ দরপত্র হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার এখতিয়ার না থাকলেও এ দরপত্রের মাধ্যমে তারা বিধি বহির্ভূত এ সুযোগটি পেয়ে যাচ্ছে। প্রকল্প জুড়ে থাকছে অনেক অনিয়ম।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, প্রকল্পটির দরপত্র আহ্বান, দরপ্রস্তাব মূল্যায়ন, কার্যাদেশ অনুমোদনের সুপারিশ এবং কার্যাদেশ প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাজের আওতা নির্ধারনে ৪ টি সুনির্দিষ্ট অনিয়ম সংঘটিত হয়েছে। যে অনিয়মগুলো আইএসপিএবি পর্যাক্রমে তুলে ধরে সেগুলো হলো-
(১) একনেক থেকে এ প্রকল্পকে ৮টি পর্যায়ে দরপত্র আহ্বানের জন্য অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু একনেকে সিদ্ধান্ত লঙ্ঘণ করে দুটি পর্যায়ে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। আর এ দুটি পর্যায়েও কেবল দুটি প্রতিষ্ঠানই দরপত্র জমা দেয়। এরমধ্যে সামিট কমিউনিকেশনস ১৩০৭টি ও ফাইবার অ্যাট হোম ১২৯৩টি ইউনিয়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের সুপারিশপ্রাপ্ত হয়। একনেকের পূর্ব-অনুমোদন ব্যতিত, দুটি প্রতিষ্ঠানের বানিজ্যিক স্বার্থ রক্ষার্থে ৮টির স্থলে ২টি প্যাকেজে দরপত্র আহ্বান বিসিসির এখতিয়ার বহির্ভূত এবং সরকারের কার্যপ্রনালি-বিধিমালার স্পষ্ট লঙ্ঘণ।
(২) দুটি দরপত্রের কার্যাদেশই দুটি প্রতিষ্ঠান ভাগাভাগি করে নিয়েছে। ১৩০৭টি ইউনিয়নের দরপত্রে ১৮৯,৯৪,২০,২৭১ টাকা দর প্রস্তাব করে সর্বনিম্ন দরদাতা একটি এনটিটিএন এবং ১২৯৩টি ইউনিয়নের অপর দরপত্রে সর্বনিম্ন ১৮৮,৫২,৩৫,৪৮৫ টাকা দর প্রস্তাব দিয়ে অপর এনটিটিএন পারস্পরিক যোগসাজশের মাধ্যমে মূল্য প্রস্তাব করেছে। দুটি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান সমঝোতার ভিত্তিতে নিজেদের মধ্যে কাজ ভাগ করে নেয়ায় এক্ষেত্রে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার কোন সুযোগ ছিলো না, যা গনখাতে ক্রয়-আইন ক্রয়-বিধিমালার সাথে সাংঘর্ষিক।
(৩) বিটিআরসির সূত্রমতে এনটিটিএ লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো শুধুমাত্র ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক স্থাপন, রক্ষনাবেক্ষণ এবং এএনএসের (অ্যাকসেস নেটওয়ার্ক সার্ভিস) কাছে ভাড়া দেয়ার এখতিয়ারপ্রাপ্ত। আর গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সেবা দেয়ার দায়িত্ব কেবল এএনএস প্রতিষ্ঠানগুলোর। তবে এ কার্যাদেশের কারণে এনটিটিএন প্রতিষ্ঠান দুটি তাদের লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করে ২ লাখ সরকারি/ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য গ্রাহক পর্যায়ে ইন্টারনেট সার্ভিস দেয়ার পরিকল্পনা শুরু করেছে। এক্ষেত্রেও তারা তাদের লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করছে।
(৪) এ দরপত্রের আওতায় ২০ বছরের জন্য কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। অথচ এনটিটিএন লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী লাইসেন্স প্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান তাদের লাইসেন্সের মেয়াদের বাইরে কোনো চুক্তি করতে পারবে না। কিন্তু ২০ বছরের মেয়াদ না থাকা সত্বেও এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানদুটি এ কাজের জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একটির লাইসেন্সের মেয়াদ প্রায় সাড়ে ছয় বছর এবং অন্যটির মেয়ার প্রায় সাতে সাতবছর। সুতরাং বিসিসি লাইসেন্সের শর্ত না মেনে প্রতিষ্ঠান দুটিকে কীভাবে ২০ বছরের কার্যাদেশ দেয়ার সুপারিশ করেছে তা আমাদের বোধগম্য নয়।